বর্তমানে প্রায় সকল শিক্ষার্থীই বিদেশে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে স্বপ্ন বাস্তবায়ন অনেকাংশে কম। যেসকল শিক্ষার্থীরা বিদেশে উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী তাদের অনন্ত এক বছর আগে থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া উচিত।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা জার্মান, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যে যেতে চান। এছাড়া এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে চীন, জাপান, মালয়েশিয়া শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকায় থাকে৷ কারণ এসকল দেশে শিক্ষা ব্যয় পশ্চিমা দেশগুলো থেকে তুলনামূলক কম।
বিদেশে উচ্চশিক্ষার খুঁটিনাটি
প্রস্তুতি গ্রহণ:
এক বা দুই মাসের প্রস্তুতি নিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। সুতরাং উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে আপনাকে ন্যূনতম একবছর আগে থেকে প্রস্তুতির প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমেই কেবল বাহিরের দেশে যাওয়া সম্ভব। প্রস্তুতির প্রথম দিকে আপনি বাহিরের কোন দেশে যেতে ইচ্ছুক এবং কোন ইউনিভার্সিটিতে পড়তে ইচ্ছুক, সেটা ঠিক করে এগিয়ে যান। প্রাথমিকভাবে কোর্স, বিশ্ববিদ্যালয় এবং তাদের অবস্থানগুলো সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নিন।
দেশ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শর্ট-লিস্ট:
আপনি যে বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে ইচ্ছুক এবং সেটি কোন দেশে অবস্থিত এর একটি লিস্ট তৈরি করে ফেলতে হবে। মাথায় রাখতে হবে বর্তমানে প্রায় বাহিরের প্রতিটি দেশেই উচ্চশিক্ষার সুযোগ রয়েছে। তাই আপনি আপনার সামর্থ্য, চাহিদা ও স্বপ্ন অনুযায়ী দেশ এবং বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন করবেন।
দেশ এবং ইউনিভার্সিটি সম্পর্কে জানুন:
কোর্সের মধ্যে কি কি অন্তর্ভুক্ত আছে, নির্দিষ্ট বিষয়টি নিয়ে গবেষণার সুযোগ, ক্যাম্পাস জীবন এবং কর্মসংস্থানের, পড়াশোনার খরচ কেমন এবং স্কলারশিপের সুযোগ আছে কিনা খুঁটিনাটি যাচাই করে নিতে হবে। প্রয়োজনে আপনি উচ্চশিক্ষা ক্যারিয়ার বিষয়ক বিভিন্ন সেমিনার বা কাউন্সিলিং গ্রহণ করতে পারেন। মোটকথা দেশ এবং ইউনিভার্সিটি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করুন। তাহলে তথ্যের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আস্তে আস্তে আপনি জানতে এবং বুঝতে পারবেন।
উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ধাপসমূহ:
ভাষার দক্ষতা পরীক্ষা:
বাহিরের দেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে ইংরেজি ভাষার দক্ষতার প্রমাণ দেখাতে হয়। এটাকেই বিদেশে উচ্চশিক্ষার যোগ্যতা প্রমাণের প্রথম ধাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এছাড়াও ইউরোপের বিভিন্ন স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ম্যান্ডারিন চাইনিজ, জার্মান, ফরাসি, আরবি, জাপানিজ ইত্যাদি ভাষাতে দক্ষ হতে হয়। ইংরেজি ভাষার প্রশংসাপত্রগুলোর ক্ষেত্রে বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো IELTS বা GRE/GMAT গ্রহণ করে থাকেন। আপনার ইংরেজির দক্ষতা বাড়াতে আপনাকে নিয়মিত ইংলিশ স্পিকিং রাইটিং ও রিডিং-এর প্র্যাকটিস করতে হবে।
সঠিক প্রস্তুতি গ্রহণ শেষে পরীক্ষা দিয়ে ভাষা দক্ষতার সার্টিফিকেট নেয়ার জন্য ব্রিটিশ কাউন্সিল, আইডিপি (ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউট সেরা মাধ্যম। IELTS-এর স্কোর ৭, GRE ও GMAT এ ৩২০ এবং ৪০০ এর মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড স্কোর ধরা হয়। ইংরেজির দক্ষতার কারণেই আপনি ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়ে যাবেন। যা আপনার বিদেশে উচ্চশিক্ষার পথ আরও সহজ করবে।
পড়াশোনার ফলাফল :
বাংলাদেশে পড়াশোনার ফলাফলের ওপর ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের বা বিষয়ে ভর্তির ব্যাপারটিও অনেক সময় নির্ভর করে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ইমেইল করেও পরামর্শ চাওয়া যেতে পারে। অনেক সময় ইংরেজি দক্ষতার ব্যান্ডস্কোরও ভর্তি বা বিষয় পাওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে।
ভর্তির প্রক্রিয়া :
বিশ্ববিদ্যালয় ও বিষয় বাছাই করার পরে অনলাইনের মাধ্যমে সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে হবে। নরওয়ে, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন ইত্যাদি দেশের কেন্দ্রীয় ভর্তি ব্যবস্থাপনার ওয়েবসাইট আছে। সেখানে আবেদন করলে আপনার যোগ্যতা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় বেছে দেয়া হয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে আবেদন করতে হয়।
সেখানে পড়াশোনার সকল সনদ কাগজপত্র স্ক্যান করে তুলে দিতে হতে পারে। পাশাপাশি এসব সেগুলোর ফটোকপি কুরিয়ার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিকানায় পাঠাতে হতে পারে। সাধারণত কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ই-মেইলের মাধ্যমে আবেদন গ্রহণ বা বাতিলের সিদ্ধান্ত জানানো হয়। আবেদনপত্র গ্রহণ করা হলে ভিসা আবেদনের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।
আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত রিসার্চ পেপার পড়া:
আপনি যদি পিএইচডি করার জন্যে যান, তবে নিজের গবেষণার স্বার্থে অবশ্যই আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীদের বা প্রফেসরদের গবেষণাগুলো পড়ুন। যা আপনার বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত। এটি আপনার ব্যক্তিগত গবেষণা পত্রের ব্যাপারেও সহায়ক হবে। এছাড়াও আপনি যে বিষয়টি পড়তে যাচ্ছেন সেটি যদি মাস্টার্স লেভেলের হয় কিংবা পিএইচডি প্রোগ্রামে হয়, তাহলে কোন ইউনিভার্সিটির কোন প্রফেসর বিষয়টি পড়াচ্ছেন, বিষয়টি নিয়ে তার নিজস্ব গবেষণা আছে কিনা বা তিনি কি কি কাজ করেছেন এসব সম্পর্কে একটু জেনে নিন। এটির জন্যে খুব ভালো কাজে দিতে পারে গুগল সার্চ ইঞ্জিন! প্রফেসরদের সম্পর্কে ভালোভাবে জানার পর আপনি উনাদের মেইল করতে পারেন৷ প্রফেসরদের সাথে ভালো যোগাযোগ বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্যে গমনের পথ সুগম করে।
ফান্ডিং-এর ব্যবস্থা:
আপনি যে দেশ বা বিশ্ববিদ্যালয়টিতে পড়াশোনার জন্য যাবেন বলে ভেবেছেন, এবার তার আনুষঙ্গিক খরচ সম্পর্কে জানতে হবে। সাধারণত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর ইত্যাদি দেশগুলোতে তুলনামূলক টিউশন ফি’র পরিমাণ অনেক বেশি। তবে আপনি বাহিরের দেশে পড়াশোনা করার পাশাপাশি একটা নির্দিষ্ট সময় কাজ করতে পারবেন।
কারণ প্রায় প্রতিটি দেশেই আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের কাজের জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় বরাদ্দ থাকে। তবে এটি আপনার পড়াশোনার খরচ বহন করতে সক্ষম নয়। তাই আপনাকে স্কলারশিপের জন্য আবেদন করতে হবে। একমাত্র স্কলারশিপই ফান্ডিং-এর সেরা উপায়। এছাড়া দেশের বাইরে যাবার পূর্বে সেই দেশে থাকার যাবতীয় ব্যয়ভার বহনের জন্য ব্যাংক-ব্যালেন্স দেখানোর ব্যাপারটি মাথায় রাখতে হবে।
ভিসা প্রক্রিয়াকরণ:
যে দেশে আপনি উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য চেষ্টা করছেন, সেই দেশে যাবার জন্য অবশ্যই আপনাকে অনুমতি নিতে হবে। সাধারণত স্টুডেন্ট ভিসার জন্য আবেদন করার আগে যে কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভর্তির জন্য অফার লেটার পেতে হয়। প্রয়োজনীয় ভর্তি ফি প্রদানের পর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানটি স্টুডেন্ট ভিসা আবেদনের জন্য প্রয়োজনীয় নথি সরবরাহ করে থাকে। ভিসা প্রক্রিয়া দেশভেদে ভিন্ন হয়। তাই ভিসা আবেদনের মুহূর্তে প্রাসঙ্গিক নিয়মগুলো ভালোভাবে অনুসরণ করতে হবে।
আবাসনের ব্যবস্থা:
বাহিরের দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আছে যারা তাদের প্রোগ্রামে ভর্তি বাবদ শিক্ষার্থীদের আবাসন সরবরাহ করে থাকে অথবা আপনি যদি ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপ পেয়ে থাকেন তাহলে আপনার পক্ষে সহজেই আবাসনের ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে। এছাড়া আপনাকে আবাসনের ব্যবস্থা করতে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। তাই আপনাকে থাকার জায়গাটি নিজের দেশ থেকে ঠিক করে যাওয়াটাই উত্তম হবে। বিদেশে উচ্চশিক্ষার সময় স্টুডেন্ট ডরমিটরি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি থাকার জন্য বেশ ভালো উপায়।
সাধারণত সব ডর্মগুলোই আলাদা থাকে কিন্তু কখনও রান্নাঘর বা বাথরুম শেয়ার করতে হতে পারে। স্থানীয়দের সাথে শেয়ার করে থাকাটা সাশ্রয়ের মধ্যে আরেকটি ভালো উপায়। এটি হতে পারে কোন একজন বা পুরো পরিবারের সাথে বসবাস করা; বাংলাদেশে যেটাকে সাবলেট বলা হয়। এগুলোর বিকল্প হিসেবে আছে অ্যাপার্টমেন্ট। এই মাধ্যমটিতে আলাদাভাবে নিজের মত করে থাকা গেলেও একটু বেশি খরচ গুনতে হবে।
অনেকে একসাথে কয়েকজন মিলে একটা অ্যাপার্টমেন্ট নিয়ে থাকে। জীবনের প্রতিটি অর্জনের অন্তরালে নিজেকে প্রমাণের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা অনস্বীকার্য। বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে যাওয়া পুরোটাই নির্ভর করে পূর্ব প্রস্তুতির ওপর।
SOP:
অনেকেই আছে সিজিপিএ ভালো না, IELTS ভালো না কিন্তু শুধুমাত্র অসাধারণ SOP লিখে বাজিমাত করেছেন। তাই কিভাবে একটি ভালো SOP তৈরি করা যায়, তা নিয়ে আগে থেকেই ভাবনা চিন্তা করুন। নিজের জানাশোনা বাড়ান, যারা ইতিপূর্বে বিদেশ গমন করেছেন উচ্চশিক্ষার জন্যে তাদের কাছে তাদের SOP নিয়ে জিজ্ঞেস করুন।
রিকমেন্ডেশন লেটার:
স্কলারশিপ পাওয়ার জন্য রিকমেন্ডেশন গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সব ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটেই এই ফরম আপলোড করা থাকে। এই ফরমের সঙ্গে ইচ্ছে করলে নিজের লেখা পেপারও যুক্ত করতে পারবে। তবে কার কাছ থেকে রিকমেন্ডেশন নিতে হবে সেইটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। অনেক ইউনিভার্সিটির রিকমেন্ডেশন লেটারে বলা হয়ে থাকে, ডিন বা প্রফেসর সমপর্যায়ের ব্যক্তি হতে হবে এবং রিকমেন্ডেশন লেটার লিখতে হয় ‘বরাবর প্রেসিডেন্ট (বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম)। তবে কিছু কিছু ভার্সিটির ক্ষেত্রে ভিন্ন।
তাই আপনাকে ডিন বা প্রফেসর হতে সব সময় রিকমেন্ডেশন লেটার সংগ্রহ করতে হবে। এছাড়া আপনার রেস্পেক্টিভ সুপারভাইজার ও আপনার জন্য অ্যাডমিশন কমিটির কাছে আপনার জন্য রিকমেন্ডেশন লেটার লিখবে। এ দুই রিকমেন্ডেশন লেটার এপ্লিকেন্ট সিলেকশনের জন্য খুব বড় ফ্যাক্টর।
No comments:
Post a Comment